চশমার ইতিহাস

চশমা কি?
সামনের দিকে নাকের উপর ভর দিয়ে, পেছনদিকে দুই কানের সাথে আটকে থাকতে পারা ফ্রেমে স্বচ্ছ লেন্স বসিয়ে তৈরি করা যে বস্তুটি  চোখের সংবেদনশীল অংশকে রক্ষা করে তাকেই মূলত চশমা বলে। 

বর্তমানে চশমা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলেও এর ইতিহাস আমাদের অনেকেরই অজানা। তাই আজকের ব্লগে আমরা জানার চেষ্টা করবো চশমার ইতিহাস সম্পর্কে। 

চশমার উৎপত্তি বা প্রচলন বহু পুরোনো, তাই নির্দিষ্ট করে একজনের নাম বলা কঠিন যিনি প্রথম চশমা উদ্ভাবন করেছেন। প্রাচীন মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিক্সে ফুটে উঠেছে মানুষ চশমা ব্যবহারের ইতিহাস। তবে সেই চশমা অবশ্যই আজকের সময়ের চশমার মতো নয়। তখন বিভিন্ন জিনিসকে পরিষ্কার ভাবে দেখার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন কাঁচ ব্যবহার করা হতো। 

খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছর আগেও মানুষ কাঁচের লেন্সের ব্যবহার সম্পর্কে জানতো। তখন তারা বিবর্ধক হিসেবে, সহজে আগুন জ্বালতে কাঁচ ব্যবহার করত। শত শত বছর আগে রোমের সম্রাটরা দূর থেকে গ্ল্যাডিয়েটরদের আকর্ষণীয় লড়াই দেখার জন্য কাঁচ বা স্বচ্ছ পাথর ব্যবহার করত। বলা হয়ে থাকে যে রোমান সম্রাট নিরো তার সাথে সুন্দর করে পালিশ করা এমেরাল্ড বা পান্নার টুকরো বহন করতেন যার ভেতর দিয়ে তাকালে সহজেই দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখা যেত। 
সরু ছিদ্র দিয়ে তাকালে যে দূরের বস্তু খানিকটা ভালোভাবে দেখা যায়, এমন তথ্য প্রাচীন মেরুবাসী ইনুইট বা এস্কিমোরা জানতো। তাই তারা হাতির দাঁতে ছিদ্র করে সেটিকে চশমার মতো ব্যবহার করতো। এতে দূরের জিনিস যেমন ভালোভাবে দেখা যেত, পাশাপাশি চোখও রোদ থেকে সুরক্ষিত থাকতো।

ছবিঃ প্রাচীন মেরুবাসীদের চশমা (সংগৃহীত)

তবে আধুনিক চশমার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। চশমা বলতে আমরা যা বুঝি, তা প্রথম দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইতালিতে প্রচলিত হয়। 
১২৬৮ থেকে ১৩০০ সালের দিকে ইতালিতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস বা আতশকাঁচ নির্মাতাদের মধ্যে কেউ একজন দুটো আতশকাঁচের মধ্যে কব্জা লাগিয়ে নাকের উপর ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেন। ফলে চোখে পরার উপযোগী চশমা তৈরি হয়ে যায়। এই কাজটি ঠিক কে করেছিলেন সে ব্যপারে ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে সে সময় জিওর্দানো দা পিসা নামের এক ব্যক্তি এ ধরনের চশমাকে জনপ্রিয় করেন বলে জানা যায়।
১৪০০ সালের দিকে ক্ষীনদৃষ্টি বা মাইওপিয়ার চিকিৎসায় উত্তল লেন্সের ব্যবহার পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। সেসময় ইউরোপের ধর্মযাজকদের মধ্যে চশমার প্রচলন হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদদের ধারণা। ওই সময়ে অঙ্কিত কিছু চিত্রকর্ম পাওয়া গিয়েছে যেখানে যাজকেরা চোখে চশমাসদৃশ বস্তু পরে বই পড়ছেন এবং লিখছেন। এমনকি পোপ দশম লিও চশমা পরতেন। ১৫১৭ সালে রাফায়েলোর আঁকা ছবিতে পোপ লিও দশমের চোখে চশমা দেখা যায়।

ছবিঃ ধর্মযাজকের চোখে চশমা (সংগৃহীত)

আধুনিক চশমার উদ্ভাবক হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে গিরোলামো সাভোনারোলা নামের এক ইতালীয় ভদ্রলোককে। তিনি ১৭২৭ সালে বর্তমান সময়ের চশমার প্রাথমিক নকশাটি তৈরি করেন। এরপর সাভেনারোলার নকশাটিকে মাথায় রেখেই চশমার নকশা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা আধুনিক চেহারা লাভ করে।
১৭৮০ সালের দিকে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নিজের প্রেসবায়োপিয়া (Presbyopia) সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ এক ধরনের লেন্স দিয়ে চশমা তৈরি করেন যা বাইফোকাল চশমা নামে পরিচিত। এই চশমার লেন্সের উপরের অংশ দূরের জিনিস আর নীচের অংশ কাছের জিনিস স্পষ্ট দেখার জন্য ব্যবহৃত হয়।
চশমার বিবর্তনের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল সিলিন্ডারাকৃতির অবতল লেন্স আবিষ্কার। বিশ্বজুড়েই বিষমদৃষ্টিজনিত সমস্যা বেশ প্রকট। এই বিষমদৃষ্টি (Astigmatism) প্রতিকারের জন্য ১৮২৫ সালে ইংরেজ জ্যোর্তিবিদ জর্জ এইরি এ ধরনের লেন্স তৈরি করেন।

১৮৮০ থেকে ১৯০০ সালের দিকে Pince-nez নামে নাকের উপর ঝুলে থাকা বিশেষ এক ধরনের চশমা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট থিওডো রুজভেল্ট এই চশমা বিশেষ পছন্দ করতেন। এছাড়া হলিউডের অভিনেতা অভিনেত্রীদের অনেকের কাছেই নাকের ওপর ঝুলে থাকা এই চশমা বেশ ভাল লাগতো। 

ছবিঃ মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডো রুজভেল্টের পছন্দের চশমা (সংগৃহীত)

সানগ্লাসকে বাংলায় বলা হয় রোদচশমা; যদিও বাংলাটা আমরা খুব একটা ব্যবহার করি না। রোদচশমা প্রধানত রোদে ব্যবহার করা হলেও রোদকে আটকানোর জন্য এর প্রচলন হয়নি। ১৩০০ সালের দিকে চীনে এই চশমা প্রথম তৈরী করা হয় বিচারালয়ের জজ সাহেবদের চোখের দৃষ্টিকে আড়াল করতে। ১৪৩০ সালের দিকে রোদচশমা চীন থেকে ইতালীতে পাড়ি জমালো এবং তারাও বিচারিক কাজেই রোদচশমা ব্যবহার করতো।
তবে বিংশ শতাব্দীতে এসে রোদচশমা বা সানগ্লাস যেন প্রাণ পায়। আমেরিকান আর্মি সানগ্লাস টেকনোলজির উন্নয়ন ও ব্যবহারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। অবশেষে ১৯২৯ সালে আধুনিক ধরনের রোদচশমার আবির্ভাব ঘটে। ১৯৩০ সালে ফস্টার গ্রান্ট কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ফস্টার আটলান্টিক সিটিতে ফস্টার গ্রান্ট সানগ্লাসের প্রথম জোড়াটি বিক্রি করেন। এরপর সত্তর দশকে হলিউড তারকারা তো রোদচশমা ব্যবহারের জন্য রীতিমত বিখ্যাত ছিলেন।

ছবিঃ লুনেটস্‌ বাংলাদেশ

সুদীর্ঘকাল ধরে চশমা ছিল শুধুই অভিজাতদের ব্যবহার্য পণ্য। ১৯ শতকেও চশমা ছিলো বিলাসিতার বস্তু, কারণ তা সকলের কাছে সহজলভ্য ছিল না। এমনকি চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকেও ফ্রেমে আঁটা চশমা ছিল সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরে ষাটের দশকে এসে প্লাস্টিকের সহজলভ্যতার কারণে কাঁচামালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। ফলে চশমাও সাধারণের হাতের নাগালে আসতে শুরু করে।  

আজকাল তো প্রযুক্তির বিশ্বে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে চশমার এমন সব হালনাগাদ রূপের আলোচনা হচ্ছে যা শুনলে যে কেউ চমকে যাবে। উচ্চাভিলাষী সব প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করা গুগল, অ্যাপলের মতো টেক জায়ান্টরা নতুন যুগের এমন চশমা তৈরির চেষ্টা করছে যা ভবিষ্যতে বাজারে এলে হয়তো পছন্দের বই পড়া থেকে শুরু করে সিনেমা দেখা কিংবা দেখানোর কায়দাটাই বদলে যাবে। 
চোখের ত্রুটি সংশোধনে আজকাল চশমার অনেক কার্যকরী বিকল্প আছে। তবুও চশমা কিন্তু যুগ যুগ ধরে তার জায়গা ধরে আছে ঠিকই। সেইসাথে কোটি মানুষের কর্মসংস্থানও টিকে আছে এই শিল্পকে কেন্দ্র করে। আজও অগণিত মানুষ ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টি থেকে স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে পাচ্ছে চশমার কল্যাণে। তাই নিঃসন্দেহে চশমা এই আধুনিক সভ্যতার অন্যতম মাইলফলক।
আর মানুষের প্রয়োজনে প্রযুক্তির হাত ধরে আরও আধুনিক হয়ে উঠুক চশমা, আরও উন্নত হোক মানব সভ্যতা।

Leave a Reply

Change